ভরতভায়না বা ভর্তের দেউল ঢিবি, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার গৌরিঘোনা ইউনিয়নে অবস্থিত ভরতভায়না গ্রামে অবস্থিত একটি প্রত্নক্ষেত্র, যা খ্রিস্টীয় ৭-৮ শতকের একটি নিদর্শন বলে ধারণা করা হয়।

[১] এটি একটি স্থানীয় কাঁচা সড়ক দিয়ে সাতক্ষীরা-দৌলতপুর জেলা পরিষদ সড়কের সাথে সংযুক্ত।

[১] এই প্রত্নস্থলটির পূর্ব দিক দিয়ে বহমান বুড়িভদ্র নদী।

পরিচ্ছেদসমূহ

১ বিবরণ
১.১ ঢিবি
১.২ উৎখননকৃত প্রত্নস্থল
২ পুরাতাত্ত্বিক খনন
৩ পাদটীকা
৪ আরও দেখুন
৫ তথ্যসূত্র
৬ বহিঃসংযোগ

বিবরণ
ঢিবি
দৌলতপুর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের প্রায় ১ কিলোমিটার দক্ষিণে, বুড়িভদ্র নদীর ডানতীরে প্রায় ৪০০ মিটার পশ্চিমে ভরতভায়না গ্রামে একটি ঢিবি রয়েছে। এসম্পর্কে যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে বাবু সতীশ চন্দ্র মিত্র ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে লিখেছেন-

ইহা এখনও ৫০ ফুট উচ্চ আছে, লোকে বলে উহা পুর্বে আরো উচ্চ ছিল, কিন্তু একবার ভূমিকম্পে অনেকটা বসিয়া গিয়াছে। স্তুপটি গোলাকার, উহার পরিধি পাদদেশে ৯০০ ফুটের অধিক হইবে। ইহার দক্ষিণ-পূর্ব্ব দিক দিয়া নদী প্রবাহিত, অন্য তিন দিকে গড়খাই ছিল, তাহার চিহ্ন আছে। দক্ষিণ দিকে নদীর নিকটে একটি পুকুরের খাত দেখিতে পাওয়া যায়। স্তুপটি সম্পূর্ণ ইষ্টকরাশিতে পরিপূর্ণ। পাদদেশে খনন করিয়া প্রাচীরের চিহ্ন পাওয়া গিয়াছিল।

[৪]

এর অব্যবহিত আগে বাংলার তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক কে. এন. দীক্ষিত এই স্থান পরিদর্শন করে যে বর্ণনা দেন তা থেকে জানা যায়, স্তুপটি প্রায় ২৫০/২৭৫ মিটার বেড় ও ১০/১২ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ছিল। তিনি সেখানে ১৬ ইঞ্চি × ১৩ ইঞ্চি × ৩ ইঞ্চি মাপের কিছু ইট দেখে অনুমান করেন যে, এখানকার ইমারতটি গুপ্ত যুগের ছিল এবং এটি ছিল একটি বৌদ্ধ সংঘারাম।[ক] শৌখিন প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নস্থলটি ভ্রমণ করে জানান, তখনও এর বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি: তখনও ঢিবিটি ৯ মিটার উঁচু ও বেড় ছিল প্রায় ২১২ মিটার। তবে তিনি জানান, ঢিবির চারদিকের ভূমি প্রায় সমতল অবস্থায় পেয়েছেন তিনি এবং ঘাসের মাঝে প্রচুর ইট দেখেছেন। তিনি জানান, সে স্থানটিকে ঢিবির অংশ ধরলে ঢিবির পরিধি হবে ৪২৪ মিটার।

[৫]

উৎখননকৃত প্রত্নস্থল
প্রথমদিকে মঠের ধারণা করা হলেও ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে এই ঢিবিতে আংশিক খনন চালানোর পরে মহাস্থানগড় সন্নিকটবর্তী গোকুলমেড়ের অনুরূপ, এবং ভারতের উত্তর প্রদেশের আহিচ্ছত্রে প্রাপ্ত ইমারতের কাঠামোর মতোই একটি কাঠামো বেরিয়ে আসে। যতটুকু অক্ষত আছে, ততটুকু দেখে পুরাতাত্ত্বিকদের অনুমান যে, এটি একটি সুউচ্চ ইটের মঞ্চ, যার মাথায় বা শিরোদেশে ভূমি থেকে ১১.৮৮ মিটার (৩৮.৯৮ ফুট) উচ্চতায় একটি চারকোণা ইমারত তৈরি হয়েছিল।

মঞ্চ তৈরির জন্য শুরুতেই পরস্পর ভেদকারী কতগুলো সমান্তরাল দেয়াল নির্মিত হয়েছিল, যার ফলে মঞ্চটির মধ্যে কতগুলো আবদ্ধ প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়েছিল। অবশ্য পরে শক্ত মাটি দিয়ে প্রকোষ্ঠগুলো ভরাট করে দেয়া হয়। খননের ফলে মাত্র ৪০টি প্রকোষ্ঠ বেরিয়ে এলেও এদের প্রকৃত সংখ্যা আরো বহুগূণ বেশি বলে পুরাতাত্ত্বিকদের ধারণা। আকার ও আয়তনে প্রকোষ্ঠগুলোর মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই। এগুলোর মধ্যে সম্পূর্ণ উন্মোচিত ৮টি প্রকোষ্ঠের পরিমাপ ২.১৮ মিটার × ১.৪৬ মিটার, ২.২৮ মিটার × ১.২১ মিটার, ২.১৬ মিটার × ১.৪৬ মিটার, ২ মিটার × ২.১০ মিটার, ২.২৭ মিটার × ১.১৪ মিটার, ১.৪১ মিটার × ১.৪১ মিটার, ২.৬৩ মিটার × ১.৩৫ মিটার, এবং ১.১২ মিটার × ২.১৯ মিটার।

[১]

মঞ্চের উপরের মূল ইমারতের কয়েকটি স্থানের মাত্র কয়েক স্তর ইট বর্তমানে (১৯৯৮) মূল অবস্থায় টিকে আছে, যার ভিত্তিতে পুরাতাত্ত্বিকদের ধারণা ভিত্তির দেয়ালগুলো ৭১ সেন্টিমিটার চওড়া ছিল। এর বাইরের দিকের পরিমাপ ১১.৩০ মিটার × ১১.৩০ মিটার, যা পরস্পর ৪টি আবদ্ধ প্রকোষ্ঠের সমন্বয়ে গঠিত। দেয়ালগুলো ২.৮০ মিটার চওড়া। এছাড়াও এর চারপাশে আরো কিছু দেয়ালের অংশবিশেষ ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছে।

তবে এগুলো মূল নির্মাণ সময়কালের পরে নির্মিত হয়েছিল বলে পুরাতাত্ত্বিকদের অনুমান। ইমারতটি সম্পূর্ণই কাদা ও ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। ইটগুলোর পরিমাপ (দৈর্ঘ্য×প্রস্থ×উচ্চতা) ৩৪ সেন্টিমিটার × ২৩ সেন্টিমিটার × ৬ সেন্টিমিটার, ৩৫ সেন্টিমিটার × ২৩ সেন্টিমিটার × ৫.৫ সেন্টিমিটার, ৩৫.৫ সেন্টিমিটার × ২৩.৫ সেন্টিমিটার × ৫.৫ সেন্টিমিটার, ৩৫ সেন্টিমিটার × ২৪ সেন্টিমিটার × ৫ সেন্টিমিটার, ৩৬ সেন্টিমিটার × ২৩.৫ সেন্টিমিটার × ৬ সেন্টিমিটার, এবং ৩৬.৫ সেন্টিমিটার × ২৩ সেন্টিমিটার × ৫.৫ সেন্টিমিটার।[১]

ভরতভায়না ঢিবির সর্বোচ্চ স্থান থেকে সব মিলিয়ে ৬.৬৫ মিটার গভীরতা পর্যন্ত খনন পরিচালিত হয়েছে (১৯৯৮), যার মধ্যে একটি উপস্তর ও সেই স্তরে আটটি উপস্তর লক্ষ্যণীয়। এছাড়া পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে নির্মাণের একটি সময়কাল ও পরবর্তিতে সংস্কারের আরেকটি সময়কাল প্রমাণিত হয়েছে। এপর্যন্ত (১৯৯৮) মোট ১২টি প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে মানুষের মূর্তিখচিত পোড়ামাটির ফলকের ভাঙ্গা টুকরা, অলঙ্কৃত ইট, খোলামকুচি ও মৃন্ময় তেলের প্রদীপ উল্লেখযোগ্য। ইটের আকৃতি, উৎখননকৃত প্রত্নবস্তু আর ইমারতের স্থাপত্যিক নকশার উপর ভিত্তি করে ধারণা করা হয় এই প্রত্নক্ষেত্রটি আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৭-৮ শতকের নিদর্শন।

[১]

পুরাতাত্ত্বিক খনন
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম এই ঢিবি উৎখনন করে। এরপর ১৯৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় উৎখনন চালানো হয় এবং ১৯৯৬-৯৭ সাল বাদে, ২০০০-০১ পর্যন্ত প্রতি মৌসুমে এখানে খননকার্য অব্যাহত থাকে।